Brief on Bilateral Relations দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

    ভারত ও বাংলাদেশ অভিন্ন ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য অনেক মেলবন্ধনের অংশীদার। সার্বভৌমত্ব, সমতা, পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার ভিত্তিতে রচিত দুইদেশের চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি সর্বব্যাপী অংশীদারিত্বকে প্রতিফলিত করে যা কৌশলগত অংশীদারিত্বকেও ছাপিয়ে যায়। এই অংশীদারিত্ব সমগ্র অঞ্চল ও এর বাইরেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মডেল হিসাবে শক্তিশালী, পরিপক্ক ও বিকশিত হয়েছে।

২.  ২০২১ সালটি দুই দেশের সর্বোচ্চ স্তরেই বেশকিছু কর্মসূচির সাক্ষী ছিল। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ২০২১ সালের ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর এটিই ছিল বাংলাদেশে তাঁর প্রথম সফর ও প্রথম বিদেশ সফর। তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

৩.  ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ভারতের রাষ্ট্রপতি সম্মানিত অতিথি হিসেবে ঢাকায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বীরত্ব ও সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্মরণে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ১২২ সদস্যের একটি দলও এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। পরে একই দিনে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ঢাকায় নবনির্মিত শ্রী শ্রী রমনা কালী মন্দিরের উদ্বোধন করেন, যা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। তিনি ভারতীয় প্রবীণ যোদ্ধা ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও মতবিনিময় করেন এবং পরে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ভারত-বন্ধুদের একটি সমাবেশে ভাষণ দেন। সফর চলাকালীন প্রদত্ত মূল ঘোষণাগুলির মধ্যে রয়েছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারের প্রথম অধিগ্রহণকারীর ঘোষণা এবং পাঁচ বছরের জন্য নতুন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বৃত্তি প্রকল্পের সম্প্রসারণ। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে ১৯৭১ সালের একটি মিগ-২১ বিমান উপহার দেওয়া হয়।

৪.  প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ২৬-২৭ মার্চ ২০২১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদ্‌যাপনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দিতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের পরে সেটিই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সফরসূচির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সাভারে জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং প্রথম বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী সাতক্ষীরা জেলার যশোরেশ্বরী মন্দির ও গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরও পরিদর্শন করেন এবং সেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সমাবেশে ভাষণ দেন। উভয় প্রধানমন্ত্রী ২৭ মার্চ ২০২১ একটি একান্ত বৈঠক ও প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা করেন এবং পরবর্তীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমন, দুই দেশের ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের মধ্যে সহযোগিতা; বাণিজ্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার উদ্দেশ্যে একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠা; বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট ট্রেনিং (বিডিএসইটি) সেন্টারের জন্য আইসিটি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই এবং প্রশিক্ষণ পরিষেবা প্রদান; এবং রাজশাহীতে ক্রীড়া সুবিধা স্থাপন সংক্রান্ত পাঁচটি দ্বিপাক্ষিক নথি বিনিময় করা হয়।

৫.  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ৫-৮ সেপ্টেম্বর ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে যান। সফরকালে তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু ও মাননীয় উপরাষ্ট্রপতি শ্রী জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার পরে নদীর পানিবণ্টন, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মহাকাশ সহযোগিতাসহ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বিষয়ক সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে রামপালের মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের ইউনিট-১ ও খুলনার রূপসা রেলওয়ে সেতু উদ্বোধন করেন; খুলনা-দর্শনা রেললাইন এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেললাইন – এই দুটি রেললাইনের জন্য প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শ চুক্তি স্বাক্ষর করেন; অনুদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রেলওয়েকে ২০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়; বাংলাদেশ সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগকে সড়ক নির্মাণের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার প্রস্তাব উত্থাপন; এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে ২৩টি ভারতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ৫টি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের অনুবাদ সম্বলিত একটি বই উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া দরগাহ ও রাজস্থানের আজমীরে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারও পরিদর্শন করেন।

৬.  পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ এস জয়শঙ্কর ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠক করেন এবং তারা যৌথভাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ জুন ২০২২ তারিখে নয়াদিল্লীতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপক পর্যালোচনা করার জন্য ৭ম যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে ড. মোমেনকে আমন্ত্রণ জানান।

৭. দুই দেশের মধ্যে উচ্চ-পর্যায়ের কর্মসূচির পাশাপাশি, ঊর্ধ্বতন পর্যায়েও বেশ কিছু মিথষ্ক্রিয়া হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সহযোগিতা পর্যটন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো চিরাচরিত খাত থেকে শুরু করে পারমাণবিক বিজ্ঞান, মহাকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তির মতন অত্যাধুনিক পর্যায়ে বিস্তৃত।

নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা:

৮.            বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর মধ্যে ৫২তম মহাপরিচালক পর্যায়ের আলোচনা (ডিজিএলটি) ১৭-২১ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উভয় দেশের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি অবৈধ মাদকদ্রব্য, জাল মুদ্রা ও মানব পাচার প্রতিরোধ, পুলিশি বিষয়ে সহযোগিতা, দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা বিদ্যমান। ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্তে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক ব্যবস্থাপনার জন্য সীমান্তজূড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, সীমানা স্তম্ভসমূহের যৌথ পরিদর্শন, নদীর সীমানাসহ যৌথ সীমানা চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াসমূহের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা:

৯.  ২০২১ সালে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে যেখানে উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল। ভারত ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের বিভিন্ন সফরকালে প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য দ্বিপাক্ষিক বিনিময় সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের আমন্ত্রণে ২০২২ সালের জুলাই মাসে ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সফর করেন; দায়িত্ব গ্রহণের পর যা ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। চলমান সহযোগিতার ব্যাপক পর্যালোচনা করার জন্য ২০২২ সালের ৮-১০ আগস্ট নয়াদিল্লীতে ৪র্থ বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ এবং তিনবাহিনী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে গুজরাটের গান্ধীনগর,  ডেফএক্সপো ২০২২ ও আইওআর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী।

১০.  ২০২২ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের বাৎসরিক পরিদর্শনসহ তাঁদের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য কার্যাবলি গৃহীত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের মাঝে বৃত্তি বিতরণ করা হয়। বৃত্তি প্রকল্পটি ২০২২-২৩ থেকে আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও, ভারতে চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা মেডিকেল স্কিম ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো বাস্তবায়ন করা হয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে আসাম ও ত্রিপুরার ভূমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে এই প্রতিবেশি রাজ্য দুটিতে সফর করে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অবদান রাখায় কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে তাঁর রাষ্ট্রীয় সফরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রবীণ ভারতীয় সৈনিকদের বংশধরদের মাঝে বৃত্তি প্রদান করেন।

সংযোগ:

১১. ১ আগস্ট ২০২১ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পঞ্চম সংস্কারকৃত রেললাইন, হলদিবাড়ি (ভারত) - চিলাহাটি (বাংলাদেশ) রেল সংযোগ কার্যকর হওয়াতে বৃহত্তর উপ-আঞ্চলিক সংযোগের পথ প্রশস্ত হয়েছে যা বাংলাদেশ থেকে নেপাল ও ভূটানে এবং তদ্বিপরীতে পণ্য পরিবহণকে সহজতর করবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত, ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ৭টি রেল সংযোগ চালু ছিল। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চালু হওয়া অন্য চারটি রেল সংযোগের মধ্যে রয়েছে পেট্রাপোল (ভারত)- বেনাপোল (বাংলাদেশ), গেদে (ভারত) – দর্শনা (বাংলাদেশ), সিংহবাদ (ভারত) - রোহনপুর (বাংলাদেশ) এবং রাধিকাপুর (ভারত) - বিরল (বাংলাদেশ)।

১২. কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে স্থলবাণিজ্য অস্বাভাবিক বাধার সম্মুখীন হওয়ার কারণে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের রেল সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আন্তঃসীমান্ত পরিবহণের জন্য রেলপথ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিগত বছরটি পণ্যবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিময়ের সাক্ষী হয়েছে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্সেল ও কন্টেইনার ট্রেন পরিষেবা দ্রুত শুরু করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল ব্যবসার উন্নয়নে প্রথমবারের মতো ৪৬৮ টন সুতা রেলপথে বেনাপোলে (বাংলাদেশ) পরিবহণ করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, রেলের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বছরে ১৩০ শতানশের অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করেছে।

১৩. সীমান্ত অবকাঠামোর বৃহত্তর আধুনিকীকরণ এবং আন্তঃসীমান্ত সংযোগ শক্তিশালী করার জন্য ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পেট্রাপোলে সমন্বিত চেক পোস্টে একটি নতুন যাত্রী টার্মিনাল উদ্বোধন করা হয়। ভারতের নবম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক অভিবাসন বন্দর, পেট্রাপোল স্থলবন্দরটি দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা বার্ষিক ২৩ লাখ যাত্রীকে সেবা প্রদান করে এবং বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধি করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এর উন্নয়ন কাজ চলছে।

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক:

১৪. বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। কোভিড-১৯ উদ্ভূত বাধা সত্ত্বেও, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে অভূতপূর্ব হারে প্রায় ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে রপ্তানি ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পেরিয়ে গেছে যা গত অর্থবছরে ছিল ৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য।

১৫. বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি)/জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটি (জেএসসি) বিদ্যুৎ সংক্রান্ত আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান করে থাকে।

উন্নয়ন অংশীদারিত্ব:

১৬. বাংলাদেশ আজ ভারতের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। সড়ক, রেলপথ, নৌপথ ও বন্দরসহ বিভিন্ন খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভারত গত ৮ বছরে বাংলাদেশকে সহজ শর্তে প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৩টি ঋণ প্রদান করেছে। তিনটি ঋণচুক্তি ছাড়াও, ভারত সরকার বাংলাদেশকে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ নির্মাণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথসমূহের ড্রেজিং এবং উচ্চ গতিতে বাংলাদেশে ডিজেল পরিবহণের জন্য ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য অনুদান সহায়তা প্রদান করছে।

১৭. হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এইচআইসিডিপি) ভারতের উন্নয়ন সহায়তার একটি সক্রিয় স্তম্ভরূপে কাজ করে। ভারত সরকার বাংলাদেশে ছাত্রাবাস, একাডেমিক ভবন, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, এতিমখানা ইত্যাদি নির্মাণসহ ৭৪টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে এবং আরও ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

১৮. মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো বিভিন্ন চলমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও বৃত্তির মাধ্যমে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগিতা প্রচেষ্টার একটি মূল উপাদান। ভারত সরকার দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাসহ অন্যান্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে।

সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন:

১৯. একটি গুরুত্বপূর্ণ আইটেক অংশীদার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮০০ জন অংশগ্রহণকারী আইটেক প্রশিক্ষণ কোর্সের সুবিধা গ্রহণ করে। কোর্সগুলি ভার্চুয়াল মোডে রূপান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম স্থগিত হয়নি এবং এই সময়ের মধ্যে ১৮০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক ই-আইটেক কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে, ভারত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০০টি "সুবর্ণ জয়ন্তী বৃত্তি" ঘোষণা করেছে এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইআইটিসমূহ ও এনআইআইটিসমূহ সহ ভারতের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অধ্যয়ন করে স্নাতক, স্নাতকূত্তর ও এম. ফিল/পিএইচডি সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট চালু করা হয়।

সাংস্কৃতিক সহযোগিতা:

২০. ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফরের সময়, উভয় প্রধানমন্ত্রী মিলে দুই বরেণ্য নেতার জীবন ও ঐতিহ্য উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। একই সফরে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে দুই দেশই স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত সরকারের সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায় এবং বাংলাদেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক (অব.) হলেন এর প্রথম অধিকারী।

২১. ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ঢাকার ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উভয়ই দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন সাংস্কৃতিক সংযোগ উদ্‌যাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগ, কত্থক, মণিপুরী নৃত্য, হিন্দি ভাষা, হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ভারত ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষে-মানুষে সংযোগ সম্প্রসারণে অবদান রাখে। বিভিন্ন বয়সের বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উৎসাহী অংশগ্রহণে উভয় কেন্দ্রে সশরীরে ক্লাস শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি চেয়ার এবং হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনানি বিভাগের ইউনানি চেয়ার পদ কার্যকর হয়েছে।

২২.  যুব সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসাবে ২০২২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন ক্যাম্পেইন ২০২২-এর একটি নবীকৃত সংস্করণ শুরু হয় যার জন্য বাংলাদেশের সেরা প্রতিভাধর যুবাদের নির্বাচন করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মতো প্রধান শহরগুলোতে অডিশন হয়। এই কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া দিয়ে, বাংলাদেশ জুড়ে ১,০০০টিরও বেশি আবেদন গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে, ১০০-সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২০২২ সালের অক্টোবরে ভারত সফর করে, যেখানে তারা নয়াদিল্লীসহ একাডেমিক/সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ববহনকারী অন্যান্য ভারতীয় শহরেও ভ্রমণ করে। প্রতিনিধি দলটি ভারতের মাননীয় রাষ্ট্রপতির সাথেও সাক্ষাৎ করেছে।

ভিসা:

২৩.  ভারতীয় ভিসা আবেদন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার লক্ষ্যে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য ভারত সরকারের নীতি অনুসরণ করে, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রয়োগ করা কোভিড-১৯ মহামারী বিধিনিষেধ মেনে বাংলাদেশ জুড়ে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলি ভারতে জরুরী চিকিৎসা সেবারপ্রার্থী ভিসা আবেদনকারীদের চাহিদা মেটাতে সীমিত পরিসরে কাজ করেছে। এখন যেহেতু এই ধরনের ব্যবস্থা শিথিল করা হয়েছে, ভারতীয় ভিসার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভিসা পরিষেবাগুলিকে বাড়ানো হয়েছে। সারা দেশে বিদ্যমান আবেদন কেন্দ্রের সংখ্যা, প্রতিদিন গৃহীত আবেদনের পরিমাণ এবং সেইসাথে ইস্যু করা ভিসার সংখ্যা সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশে ইস্যুকৃত ভারতীয় ভিসাসমূহ বিশ্বব্যাপী ভারত কর্তৃক পরিচালিত বৃহত্তম ভিসা অপারেশন হিসেবে পরিগণিত।

কোভিড-১৯ মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা:

২৪.  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমন্ত্রণে সার্ক নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলেন যাতে তাঁরা নিজ নিজ দেশের মহামারী পরিস্থিতির মূল্যায়ন, সর্বোত্তম অনুশীলন বিনিময় এবং রোগটির বিস্তার হ্রাস ও প্রশমনে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা চিহ্নিত করতে পারেন। ভারত সরকার কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ও যত্নের বিষয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন অনলাইন প্রশিক্ষণ মডিউলও পরিচালনা করছে।

২৫.  এখন পর্যন্ত, ভারত সরকার মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চলমান প্রচেষ্টায় সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ৩.৩ মিলিয়ন কোভিশিল্ড (অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা)টিকা উপহার দিয়েছে। এটি ভারত কর্তৃক যে কোনো দেশকে উপহার দেওয়া ভারতে উৎপাদিত কোভিড ভ্যাকসিনের বৃহত্তম কিস্তি। বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড অব বাংলাদেশ এবং সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া (এসআইআই) বাণিজ্যিকভাবে এসআইআই থেকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ৩০ মিলিয়ন ডোজ সংগ্রহের জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

২৬.  ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আইএনএস সাবিত্রীর সহায়তায় দুটি 'মোবাইল অক্সিজেন প্ল্যান্ট' বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে আমদানির অংশ হিসেবে, ভারত প্রথমবারের মতো রেলে কন্টেইনারে লিকুইড মেডিকেল অক্সিজেন (এলএমও) পরিবহনের জন্য 'অক্সিজেন এক্সপ্রেস' ট্রেন পরিচালনা করে। মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা যখন বৃদ্ধি পেয়েছিল, বিশেষত কোভিড -১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন সময় এই জাতীয় ২০টি ট্রেন পরিচালনা করা হয়েছিল। ২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রতিশ্রুতি অনুসারে ভারত বাংলাদেশকে ১০৯টি লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর করেছে। বন্ধুত্বের আরেকটি নিদর্শন হিসেবে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে অক্সিজেন ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন ফেস মাস্ক, অক্সিজেন ফ্লো মিটার, নন-রিব্রেদার মাস্ক, পালস অক্সিমিটার, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, মেডিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং ইনফ্রারেড থার্মোমিটার সহ প্রায় ২০ টন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া হয়।

***

২২ নভেম্বর ২০২২