২০২০-র ইন্ডিয়া আইডিয়াজ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বিবৃতি ও বক্তৃতা

২০২০-র ইন্ডিয়া আইডিয়াজ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

২০২০-র ইন্ডিয়া আইডিয়াজ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

নয়াদিল্লি, ২২ জুলাই, ২০২০

 
নমস্কার!

বাণিজ্য মহলের নেতৃবৃন্দ,

সম্মানীয় অতিথিবৃন্দ,

আমাকে ‘ইন্ডিয়া আইডিয়াজ সামিট’-এ বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারত-মার্কিন বাণিজ্য পরিষদকে (ইউএসআইবিসি) আমি প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই। আমি ইউএসআইবিসি-কে বর্তমান বছরে তাদের ৪৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে অভিনন্দন জানাই। বিগত কয়েক দশক ধরে ইউএসআইবিসি ভারতীয় এবং মার্কিন বাণিজ্যকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ইউএসআইবিসি-র এ বছরের সম্মেলনের মূল ভাবনা - ‘উন্নত ভবিষ্যৎ গড়া’ - অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। 

বন্ধুগণ,

বিশ্বের উন্নত ভবিষ্যতের প্রশ্নে আমরা সকলেই একমত, আর তাই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আজ একজোট হয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের প্রয়াস হওয়া উচিৎ মানবিক। আমাদের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হবেন দরিদ্র এবং সমাজের পেছনের সারিতে থাকা মানুষেরা। ‘সহজ জীবনশৈলী’, সহজে ব্যবসা করার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

বন্ধুগণ,

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে দক্ষ এবং নিখুঁত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। দক্ষতা খুব ভালো জিনিস। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমরা আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যাই। বাইরে থেকে কোন আঘাত এলে তাকে প্রতিহত করার দৃঢ়তার বিষয়টি আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। বিশ্ব জুড়ে মহামারী আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় দৃঢ়তা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

বন্ধুগণ,

আন্তর্জাতিক অর্থনীতির দৃঢ়তা দেশের অভ্যন্তরের অর্থনীতির ক্ষমতার মাধ্যমে তৈরি হয়। অর্থাৎ, দেশের অভ্যন্তরের ক্ষমতা౼ উৎপাদন ক্ষেত্র, আর্থিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যের বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়। 

বন্ধুগণ,

সমৃদ্ধ এবং আত্মনির্ভর বিশ্ব গড়ার উদ্দেশে ভারত ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ডাক দিয়েছে। আর তাই আমরা আপনাদের সহযোগিতার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি।

বন্ধুগণ,

আজ আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের প্রতি একটি আস্থা তৈরি হয়েছে। এর মূল কারণ ভারত অবাধ সুযোগ এবং বেছে নেওয়ার অধিকার সবাইকে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আপনাদেরকে আরও বিস্তারিতভাবে বলছি। ভারতের জনগণ অত্যন্ত মুক্তমনা এবং আমাদের দেশের সরকারও। আর এই মুক্ত চিন্তার থেকে মুক্ত বাজার তৈরি হয়েছে। মুক্ত বাজার আরও ব্যাপক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই নীতিগুলিই ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে। 

বন্ধুগণ,

বিগত ছয় বছরে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে আরও মুক্ত করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি যা ছিল সংস্কারমুখী। সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে - এর থেকে স্বচ্ছতা বেড়েছে। আর এসবের হাত ধরে ডিজিটাইজেশন, আরও ব্যাপক উদ্ভাবন এবং স্থিতিশীল নীতি গ্রহণের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

বন্ধুগণ,

ভারত সম্ভাবনার একটি নতুন জায়গা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি আপনাদেরকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রযুক্তি ক্ষেত্রের কথাটা ভাবুন। ভারতের জন্য সম্প্রতি একটি আকর্ষণীয় তথ্য সামনে এসেছে। প্রথমবারের মতো গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যা শহরাঞ্চলের থেকে বেশি। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন! ভারতে এই মুহূর্তে প্রায় ৫০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। ৫০ কোটি মানুষের সঙ্গে ইন্টারনেটের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। একটু অবাক হচ্ছেন? দাঁড়ান। কারণ আরও ৫০ কোটি মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রযুক্তির এই সুযোগের মাধ্যমে ফাইভ-জি, বিগ ডেটা অ্যানালিটিক, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লক চেন এবং ইন্টারনেট অফ থিঙ্গস-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

বন্ধুগণ,

ভারতে বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের জন্য ভারত আপনাদের বিনিয়োগ করতে বলছে। ভারত কৃষিক্ষেত্রে সম্প্রতি ঐতিহাসিক সংস্কার ঘটিয়েছে। এখানে অনেক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কৃষিজ যন্ত্রপাতি, কৃষিক্ষেত্রে সাপ্লাই চেনের ব্যবস্থাপনা, তৈরি করা খাবার, মৎস্যসম্পদ এবং অর্গ্যানিক শস্য উৎপাদনের মতো সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারতের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল পরিমাণ হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে আরও উন্নতির জন্য ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগের এটাই সবথেকে ভালো সময়।

আমাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আপনাদের বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। প্রতি বছর ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্র ২২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সংস্থাগুলি চিকিৎসা-প্রযুক্তি, টেলি-মেডিসিন এবং বিভিন্ন পরীক্ষাগারের জন্য যন্ত্রপাতি তৈরিতে যথেষ্ট উন্নতি করছে। ওষুধ প্রস্তুত শিল্পে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক অংশীদারিত্ব রয়েছে। এই ক্ষেত্রকে আরও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য এটাই আপনাদের কাছে আদর্শ সময়।

বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ভারত আপনাদের বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে। ভারত এখন গ্যাস-ভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে চলেছে। মার্কিন সংস্থাগুলির জন্য এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে স্বচ্ছ জ্বালানির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগের দারুণ সুযোগ আছে। আপনাদের বিনিয়োগে উৎসাহদানের জন্য বলতে পারি ভারতে বিদ্যুৎক্ষেত্রে বিনিয়োগের এটাই সবথেকে ভালো সময়।

আমাদের পরিকাঠামোতে বিনিয়োগের জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম সর্ববৃহৎ পরিকাঠামো সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আসুন, আপনারাও লক্ষ লক্ষ গৃহ নির্মাণ অথবা সড়ক, মহাসড়ক এবং বন্দর নির্মাণে আমাদের অংশীদার হোন।

অসামরিক বিমান চলাচল আরেকটি ক্ষেত্র, যেখানে উন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভবনা আছে। আগামী আট বছরের মধ্যে বিমান যাত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে চলেছে। ভারতের সবথেকে বড় বেসরকারি বিমান সংস্থাটি আগামী দশকে এক হাজারের বেশি বিমানকে তাদের পরিষেবায় যুক্ত করতে চলেছে। এ দেশের উৎপাদন শিল্পেও বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে কারণ আঞ্চলিক বাজারে ভারত একটি বড় সরবরাহের কেন্দ্র হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতি এবং পরিচালন ক্ষেত্রেও একই সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিমান চলাচল শিল্পে আপনারা উৎসাহী হলে ভারতে বিনিয়োগের এটাই আদর্শ সময়।

ভারত আপনাদের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র এবং মহাকাশে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আমরা ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছি। আমরা দুটি প্রতিরক্ষা করিডর তৈরি করেছি। এর ফলে, সেখানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী সংস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। আমরা বেসরকারি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেছি। কয়েক সপ্তাহ আগে মহাকাশ ক্ষেত্রেও আমরা যুগান্তকারী সংস্কার ঘোষণা করেছি। আসুন, এই ক্ষেত্রগুলিতে আপনারা আমাদের অংশীদার হোন। 

ভারত আপনাদের আর্থিক এবং বীমা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে। বীমা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৪৯ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী বীমা ব্যবস্থায় ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগেরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতে বছরে ১২ শতাংশেরও বেশি হারে বীমা বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল হতে চলেছে। আয়ুষ্মান ভারতের সাফল্যের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য বীমা, পিএম ফসল বীমা যোজনা - অর্থাৎ আমাদের শস্য বীমা প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প – জন সুরক্ষার মতো ক্ষেত্রে সরকার বীমার সুযোগ তৈরি করেছে। স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন বীমায় এখনও অনেক সুযোগ গ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এবং নিশ্চিত লাভের জন্য ভারতের বীমা ক্ষেত্র বিনিয়োগের অত্যন্ত আদর্শ একটি স্থান।

আমি আপনাদের  বিনামূল্যে বেশ কিছু পরামর্শ এখানে দিতে চাই।

বন্ধুগণ,

যখন বাজার মুক্ত করে দেওয়া হয়, যখন প্রচুর সুযোগ তৈরি হয়, তখন আস্থা কি দূরে থাকতে পারে?  আপনারা দেখেছেন, বিভিন্ন বাণিজ্যিক মূল্যায়নে ভারত ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে আসছে -  বিশেষ করে,  বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহজে বাণিজ্য করার রেটিং-এ।

আস্থার সবথেকে ভালো প্রতিফলন বিনিয়োগ। প্রত্যেক বছর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণে আমরা নতুন রেকর্ড তৈরি করছি। আগের বছরের থেকে প্রতি বছর বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতে ৭,৪০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যা গত বছরের থেকে ২০ শতাংশ বেশি। ইউএসআইবিসি জানিয়েছে এ বছর ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। আপনারা দেখুন এই মহামারীর সময়ের ব্যাপারটা। এই কোভিডের মধ্যেও এপ্রিল থেকে জুলাই – এই সময়সীমায় ভারত ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে।

কিন্তু, ভারত আরও অনেক সুযোগ আপনাদের সামনে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য যে ক্ষমতার প্রয়োজন, আমাদের তা রয়েছে।

বন্ধুগণ,

ভারতের উত্থানের অর্থ হল বাণিজ্যের সুযোগের উত্থান, একটি দেশ যাকে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন, আন্তর্জাতিক সংহতির উত্থান, যেখানে মুক্ত অর্থনীতির আরও সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাজারে ঢোকার অধিকার তৈরি হওয়ায় প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং আপনারা বিনিয়োগ করলে আপনাদের বিনিয়োগ থেকে লভ্যাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ।এ সবের সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদও আপনারা ভারতে পাবেন।

বন্ধুগণ,

এই স্বপ্ন নিয়ে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত ভালো সহযোগী আর নেই। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি গতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যারা সম-মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। আমরা স্বাভাবিক সহযোগী। ভারত-মার্কিন বন্ধুত্ব বর্তমানে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এখন এই মহামারীর পরে বিশ্বকে আবার আগের ছন্দে নিয়ে আসতে আমাদের অংশীদারিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা কোন দেশের কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার জন্য সঠিক সময় খোঁজেন। তাঁদের আমি বলতে চাই, ভারতে বিনিয়োগের এর থেকে ভালো সময় আর পাবেন না।

আমি আরও একবার ইউএসআইবিসি নেতৃত্বকে ভারত-মার্কিন আর্থিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের জন্য ধন্যবাদ জানাই। ইউএসআইবিসি একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাক!

ভারত-মার্কিন বন্ধুত্ব আরও বিকশিত হোক!

নমস্কার!

ধন্যবাদ!